09 May 2024, 05:17 pm

বুদ্ধির মুক্তি —- এম এ কবীর (সাংবাদিক)

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

যেকোনো পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন জ্ঞান সাধনা ও বুদ্ধির সম্প্রসারণ। যে জাতি জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করেছে সেই জাতিরই পতন হয়েছে। দার্শনিক সক্রেটিসের মূল দর্শন ছিল,‘ঠরৎঃঁব রং শহড়ষিবফমব.’ অর্থাৎ সৎ গুণই জ্ঞান। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের মধ্যে যেসব গুণাবলি তৈরি হয় তা জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই হয়। তিনি আরো বিশ্বাস করতেন যে, মানুষ যা ইচ্ছা করে তা বোঝার জন্য জ্ঞানীয় শক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়, যখন আবেগের ভূমিকা হ্রাস করে। জ্ঞান ব্যতীত একটি সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় জ্ঞান চর্চার জায়গা কতটা স্বাধীন এবং জ্ঞানীর কদরই বা কতটুকু?

রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সেক্টরভিত্তিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের মুঘল বাদশাহরাও নিয়োগ দিতেন। মুঘল সম্রাট আকবরের রাজ দরবারে বুদ্ধি পরামর্শ দেয়ার জন্য ৯ জন পরামর্শদাতা ছিলেন যাদের নবরত্ন বলা হতো। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা ছিলেন অসামান্য জ্ঞানী,  শ্রেষ্ঠ ও অতুলনীয়। তার দরবারে নবরত্ন যারা ছিলেন তারা হলেন, সভাকবি আবুল ফজল, প্রতিরক্ষামন্ত্রী আব্দুল রহিম খান, প্রধানমন্ত্রী বীরবল, গায়ক ফৈজি, ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা ফকির আজিওদ্দিন, সেনাপতি মানসিংহ, গৃহমন্ত্রী মোল্লা দোপেঁয়াজা, সংস্কৃতিমন্ত্রী তানসেন এবং অর্থমন্ত্রী টোডরমল। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, সম্রাট বিক্রমাদিত্যের দরবারেও নবরত্ন ছিলেন, যারা জ্ঞান-গরিমায় ছিলেন এক ও অনন্য। নবরত্নদের যিনি যে কাজে পারদর্শী তাকে সেই কাজেরই দায়িত্ব দেয়া হতো। এই জন্য তাদের চিন্তাচেতনা প্রসূত কাজের দৃষ্টান্ত এখনো সামনে আনা হয়।

‘জ্ঞানই শক্তি, জ্ঞানই সুপার পাওয়ার’ এই সত্যটি আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নেতারা উপলদ্ধি করতে না পারলেও উন্নত রাষ্ট্রগুলো জ্ঞানীদের খুঁজে খুঁজে বের করে রাষ্ট্রের উন্নয়নে কাজে লাগায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের দেশে কেউ যদি জ্ঞান চর্চা করেছে তো সেই বেটার জীবন জিন্দেগি শেষ। এই দেশে জ্ঞান চর্চার পরিবর্তে তোষামোদি আর নগদায়নকে খুব বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। সে জন্য আমাদের দেশে সরকার প্রধান থেকে শুরু করে হৃষ্টপুষ্ট ব্যক্তিদের পাশে মোসাহেব ব্যতীত আর কাউকেই ভিড়তে দেয়া হয় না।

জ্ঞানীর কদর জ্ঞানীরাই দিতে জানেন। বিশ্ব বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটলের ছাত্র আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এবং দার্শনিক ডায়োজিনিস। আলেকজান্ডার দার্শনিক ডায়োজিনিসের কথা শুনে ঠিক করলেন তার সাথে দেখা করবেন। ডায়োজিনিস যেখানে থাকতেন সেখানে গিয়ে দেখলেন ডায়োজিনিসের আবাস হলো পরিত্যক্ত বিশাল একটি টব বা মদের ভাড়, তিনি সামান্য কাপড় পরে আছেন, দেখতে পাগল ধরনের। ডায়োজেনিসের সামনে গিয়ে আলেকজান্ডার বললেন, ‘আমি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট।’  ডায়োজেনিস বললেন, ‘আমি ডায়োজেনিস দ্য সিনিক।’ আলেকজান্ডার বললেন, ‘আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন না?’ ডায়োজেনিস বললেন, ‘কেন? তোমাকে ভয় পেতে হবে কেন? তুমি ভালো না খারাপ?’ আলেকজান্ডার বললেন, ‘অবশ্যই ভালো।’ ডায়োজেনিস বললেন, ‘তো ভালো জিনিসকে কেউ ভয় পায়? সম্রাট আলেকজান্ডার তার কী উপকার করতে পারেন এরূপ প্রশ্ন করলে তিনি ব্যঙ্গসহকারে বলেন, আপনি দয়া করে আমার সূর্যের আলোটুকু আড়াল না করে সরে দাঁড়াতে পারেন। তিনি আলেকজান্ডারকে বুঝাতে চাইলেন, ক্ষমতার ছায়া যেন জ্ঞানের আলোকে আড়াল করতে না পারে। এই কটু কথা শুনেও ডায়োজেনিসের সাথে প্রথম আলাপেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন আলেকজান্ডার এবং তিনি তার সঙ্গীদের বললেন, ‘আমি যদি আলেকজান্ডার না হতাম, তবে ডায়োজেনিস হতে চাইতাম!’

ডায়োজেনিস সবসময় যেভাবে পছন্দ করতেন, সেভাবেই চলতেন। কথা বলার অধিকার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা মানুষের সবচেয়ে সেরা সম্পদ। একবার তাকে বাজারে হ্যারিকেন হাতে হাজির হতে দেখে,কী করছেন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘ তিনি আসলে মানুষ খুঁজছেন’। হ্যারিকেন দিয়ে সৎ মানুষ খোঁজার প্রচেষ্টায় লোকজন যথেষ্ট অপমানিত হওয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘গ্রিসের কোথায় তিনি সৎ আর ভালো মানুষ খুঁজে পাবেন, কেউ কি বলতে পারবে’?

বর্তমান সময়ে, যেখানে মানুষ কেবল যশ খ্যাতি এবং ঐশ্বর্যের পেছনে নিরন্তর ছুটে চলেছে, যেখানে মানুষের বিলাসিতার চাদরে মুড়ে থাকার প্রবণতা বেড়েছে; সেখানে ডায়োজেনিস দ্য সিনিক হতে পারেন আমাদের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জ্ঞানের কাজ হচ্ছে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা। ক্ষমতা, লোভ-লালসা, আর ভয়ের রক্ত-চক্ষুকে পরোয়া না করে একটি নির্মোহ রাষ্ট্র কিংবা সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে জ্ঞানের কাজ। সক্রেটিসের রাষ্ট্র কাঠামোতে রাষ্ট্রের প্রধানকে অবশ্যই দার্শনিক হতে হবে। যিনি হবেন সত্য এবং সুন্দরের পূজারি, উত্তম চরিত্রের অধিকারী, লোভ-লালসা যাকে স্পর্শ করবে না।

আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ সা: ঘোষণা করেছেন, ‘আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি। যাতে মানবজাতিকে উত্তম চরিত্রের শিক্ষা প্রদান করতে পারি’ (তিরমিযী)। শিক্ষা তথা জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরজ’ (বায়হাকি : ১৬১৪)। এমনকি হেরা গুহায় ধ্যানরত নবী সা:-এর কাছে হজরত জিব্রাইল (আ:) সর্বপ্রথম যে আসমানি পয়গাম নিয়ে এসেছিলেন তা ছিল- ‘পড় তোমার প্রভুর নামে’। কেননা পড়া ব্যতীত কোনো জাতির সুপ্ত মেধার বিকাশ ঘটতে পারে না, পৌঁছাতে পারে না উৎকর্ষতার চরম সোপানে। পবিত্র কুরআনুল কারিমে বর্ণিত হয়েছে, ‘যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে’? (সূরা জুমার : ৩৯:৯) জ্ঞান অন্বেষণের পথকে নবী সা: জান্নাতের পথ বলে ঘোষণা করেন। নবী করীম সা: বলেন ‘আসমান ও জমিনে অবস্থানকারী সবাই এমনকি গভীর পানির মাছও জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য দোয়া করে’ (মেশকাত)। জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে হজরত আলী (রা:) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমত্তার (জ্ঞানের) চেয়ে মূল্যবান সম্পদ আর নেই এবং মূর্খতার চেয়ে বড় দারিদ্র্য আর নেই। ভদ্রতার চেয়ে বড় উত্তরাধিকার আর নেই এবং পরামর্শের চেয়ে বড় সাহায্যকারী আর নেই।’ জ্ঞানী লোকদের আল্লাহ তায়ালা উচ্চমর্যাদা দান করবেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদের সুউচ্চ মর্যাদা দান করবেন’ (সূরা মুজাদালাহ, আয়াত-১১)।

সুতরাং রাষ্ট্র, সমাজ-সংসারে সুখ ও সমৃদ্ধি ঘটানোর জন্য জ্ঞান এক অপরিহার্য বিষয়। রাষ্ট্র ও সংগঠন পরিচালনার পরিকল্পনা তৈরির জন্য প্রয়োজন জ্ঞান ও বুদ্ধির সম্প্রসারণ। জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কিন্তু এখন যারা এক ব্যক্তির শাসন বা একনায়কতান্ত্রিক শাসন কিংবা মূর্খের শাসন পছন্দ করেন স্বাভাবিক অর্থে তারা জ্ঞানীকে ভয় পান; কারণ জ্ঞানীকে আটকে রাখতে পারলেই তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করা সহজ হয়ে যায়।

মানুষের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। এই সীমাবদ্ধ জ্ঞান সব বিষয়ে মানুষকে নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত করে না। তা মানুষকে ভুল পথেও পরিচালিত করে। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার বিষয়ে মহান আল্লাহর ঘোষণা, ‘…তোমাদের (মানুষকে) অতি সামান্য জ্ঞান দেয়া হয়েছে।’(বনি ইসরাইল : ৮০) ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান পায়নি, সে কি পেয়েছে? যে ব্যক্তি ইলম বা জ্ঞান পেয়েছে তার পাওয়ার কি বাকি আছে? আপনি যদি নিঃস্ব হয়ে যান, তবে জ্ঞানই হবে আপনার সম্পদ। আর যদি ধনাঢ্য হয়ে যান, তবে জ্ঞানই হবে আপনার অঙ্গসজ্জা, যা আল্লাহর স্মরণ থেকে আপনাকে গাফেল করবে না। জ্ঞানী ও মূর্খ কোনো দিন সমান নয়। ‘দৃষ্টিমান ও দৃষ্টিহীন সমান নয়; সমান নয় অন্ধকার ও আলো, সমান নয় ছায়া ও রৌদ্র।’ (সুরা ফাতির : ১৯-২১) আল্লাহতায়ালাকে না মানা জ্ঞান রিপুতাড়িত জ্ঞান, যা জীবনকে লাগামহীন করে, ভুল সিদ্ধান্তে ও ভুল পথে পরিচালিত করে জ্ঞানীকে। ‘যারা ইমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদায় আরও উন্নতি দান করবেন।’ (সুরা মুজাদালা : ১১) জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সবার জন্য। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুমিন নর-নারীর জন্য ফরজ।’

ছান্দসিক কবি আব্দুল কাদির বলেছেন- ‘ জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। এই বাক্য থেকে জ্ঞান আর বুদ্ধি’র মাঝে পার্থক্যটা আসলে কী, তা না বুঝলেও এটা বোঝা যায়, জ্ঞান আর বুদ্ধি’র মধ্যে পার্থক্য যে আছে তা নিশ্চিত। উনিশ শতকের বিশের দশকে মুসলমানদের ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন হয়েছিল। তখন মুসলমানরা জ্ঞান-বুদ্ধিতে পিছিয়ে পড়েছিল; কারণ ব্রিটিশরা জেঁকে বসেছিল দেশ পরিচালনার গদিতে।

‘জ্ঞানই শক্তি’ নামে একটা শক্তির কথা আমরা তখন থেকেই জেনেছি যখন আমাদের কোনো শক্তিই ছিল না। এই শক্তির কথা নাকি প্রথম বলেছিলেন স্যার ফ্রান্সিস বেকন যিনি একজন ইংরেজ দার্শনিক, আইনজ্ঞ, কূটনীতিক এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার পথপ্রদর্শক। যদিও বলা হয় বেকনের ইংরেজি বা লাতিন রচনায় এই সুনির্দিষ্ট বাক্যাংশের কোনো অস্তিত্ব নেই। ‘সায়েন্টিয়া পেন্টিয়েনা এস্ট’ শব্দটি একটি লাতিন আফোরিজম যার অর্থ ‘শহড়ষিবফমব রং ঢ়ড়বিৎ’; এই শক্তির বলেই হয়তো তিনি আইনজীবী হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করলেও বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের প্রবক্তা এবং জ্ঞানান্ধতা ও গোঁড়ামিবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত হন।

বুদ্ধি বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। থর্নডাইকের মতে, অনুষঙ্গ বা বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সংযোগ সাধনের ক্ষমতাই বুদ্ধি। স্পিয়ারম্যানের মতে, বুদ্ধি হলো নিজের মনের প্রতিক্রিয়াগুলোকে লক্ষ করার ক্ষমতা, জ্ঞানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় সম্বন্ধ আবিষ্কারের ক্ষমতা। বুদ্ধি মানুষ জন্মগতভাবেই লাভ করে। জ্ঞান পরিবার, সমাজ ও পরিবেশ থেকে অর্জন করতে হয়। জন্মের পরই শিশু খাবার খেতে হবে সে জানে, মায়ের স্তনের কাছে নিলেই সে বোঝে এখানে তার খাদ্য আছে, ক্ষুধা পেলে কান্না করতে হবে সে জানে, এগুলো তার বুদ্ধি জন্মগতভাবেই পেয়েছে। এমনকি অন্য প্রাণীর মধ্যেও বুদ্ধি আছে , বাঘ জানে শিকার করতে কোথায় কামড়ে ধরলে তার জন্য সহজ হবে, আত্মরক্ষা কীভাবে করতে হবে সেটা সব প্রাণীই বোঝে, আত্মরক্ষার জন্য সংঘবদ্ধ হয়ে চলতে হবে সেটা বন্য প্রাণীরাও জানে,এটা জন্মগতভাবে সব প্রাণীরই থাকে কম বা বেশি। এটাকে আরবিতে ‘আক্বল’ বলে, আমরা আক্কেল-বুদ্ধি বলি।

একেবারে নিরক্ষর মানুষও পরিবার, সমাজে চলতে বা চালাতে যে স্বাভাবিক বুদ্ধি লাগে তা জানে অনেক ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষিত লোকের থেকে বেশিই থাকে। এই বুদ্ধিমত্তা আসে জন্মের মাধ্যমে। বুদ্ধিমত্তা যখন জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়, তখন তা জ্ঞানের জন্ম দেয়। অর্জিত জ্ঞান সঠিকভাবে কাজে লাগানোর বিশেষ জ্ঞানকে প্রজ্ঞা বলে।

সত্য ও প্রকৃত জ্ঞানের স্বরূপ উদঘাটন নিয়ে জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎশের মত হলো, “পৃথিবীর সব বস্তুকে একেকটা নির্দিষ্ট রূপক অর্থ দিয়ে মানুষ নিজেদের মতো করে নাম দিয়েছে এবং তাকে প্রতিষ্ঠা করেছে পূর্ণাঙ্গ সত্য হিসেবে। প্রত্যেক বস্তুর আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রত্যেক বস্তুকে বুঝতে হলে ঐ বস্তুর মধ্যে লুকায়িত সত্য ও স্বাতন্ত্রবোধ খুঁজতে হবে। এই স্বাতন্ত্রবোধ খুঁজে বের করার মধ্য দিয়েই সেই বিষয় বা বস্তুর স্বরূপ উদঘাটন করা সম্ভব যা প্রকৃত সত্য ও জ্ঞান।”

নীৎশের মতে, “মানুষ সমাজ কর্তৃক স্ক্রিপ্টেড জ্ঞান সম্পর্কে অবগত হয় কিন্তু এই জ্ঞানের স্বরূপ না জানার কারণে জ্ঞানের দম্ভ করে বেড়ায়, তার মাধ্যমে সে নিজের দুর্বলতায় প্রকাশ করে দেয়। অনেক সময় সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত সত্য প্রকৃত সত্য উদঘাটনের পথে বাধা হয়েও দাঁড়ায়। সত্যের ছোয়া বিহীন জ্ঞানীরা মনে করে তাদেরকে নিয়ে সাধারণ মানুষ চিন্তা করে এবং জ্ঞানী ভাবে। এর রহস্য হলো- প্রকৃত সত্য সম্পর্কে অবগত না হওয়া। মানুষ যতই সত্য উপলব্ধি করতে পারে ততই সে দম্ভ থেকে মুক্ত হয়ে উঠে এবং প্রকৃত জ্ঞানী হয়ে উঠে।”

সমাজ কর্তৃক তৈরী রূপক সত্যকে প্রকৃত সত্য হিসেবে মেনে নেয়ার যে রীতি চলমান তা প্লেটোর এলিগরি অব দ্য ক্যাভ থিওরির সাথে মিলে যায়। যেখানে  প্লেটো দেখায়, কিছু মানুষ দীর্ঘদিন ধরে একটি গুহায় হাত পা বাঁধা অবস্থায় বন্দী থাকে। তাদের সামনে কিছু প্রাণীর ছায়া ভেসে উঠত তারা সে ছায়াকেই প্রকৃত সত্য হিসেবে মেনে নিতো। বন্দীদের মধ্য থেকে একজন একদিন মুক্ত হয়ে গুহার বাইরে চলে আসে এবং আবিষ্কার করে প্রকৃত সত্য সে বুঝতে পারে, যে ছায়াকেই তারা সত্য হিসেবে বিবেচনা করতো তা নিছক ভ্রম। প্লেটো তার এই থিওরির দ্বারা তুলে ধরেছেন, সমাজ দীর্ঘদিন ধরে যে বিষয়কে সত্য বলে আসছে তা মিথ্যাও হতে পারে। প্রকৃত সত্য উপলব্ধি ও আবিষ্কারের জন্য প্রয়োজন সমাজ কর্তৃক তৈরী জ্ঞানের শেকল ভাঙা।

সত্য ও সত্যের পথ খুঁজতে বিখ্যাত লেখক এমারসন লিখেছেন ‘সেল্ফ রেলিয়েন্স’। এই প্রবন্ধে তিনি বারবার গুরুত্ব দিয়েছেন ব্যক্তির স্বাতন্ত্রের প্রতি। পৃথিবীর অন্য কিছুর প্রতি বিশ্বাসের আগে নিজেকে বিশ্বাস করতে বলেছেন। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারলেই মানুষ সত্য ও জ্ঞানের সন্ধান পাবে, পাবে ঐশী আলোর সন্ধান। নিজের পথে চলতে গিয়ে সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত সত্য যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা নির্দ্বিধায় উপেক্ষা করতে বলেছেন। পৃথিবীর প্রকৃত জ্ঞানীরা নিজ পথে ভ্রমণ সত্যের স্বরূপ উদঘাটন করেই পৃথিবীকে দিয়েছেন নতুন তত্ত্ব ও তথ্য। একজন মানুষ জীবন ও জগৎ থেকে যে রহস্য উদ্ধার করতে পারে যদিও তা সমাজস্বীকৃত নয় তাই তার জ্ঞান, তাই সত্য। কাজী নজরুল ইসলাম ‘আমার পথ’ প্রবন্ধে দৃঢ় চিত্তের সাথে উল্লেখ করেছেন- “আমার সত্যই আমার পথ।”

সক্রেটিস আবার নৈতিক উৎকর্ষের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। সক্রেটিসের মতে, মানুষ যখন নৈতিক ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠে এবং সত্যের খোঁজ করে তখন সে আত্মিক, আধ্যাত্মিক ও বাস্তবিক সত্য সম্পর্কে অবগত হতে থাকে। আর এই সত্যই হলো জ্ঞান। সক্রেটিসকে এই সত্য ও তার উপলব্ধ জ্ঞান আঁকড়ে ধরতে গিয়ে তৎকালীন রাজা কর্তৃক হেমলক পান করানো হয়, মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয়।

অনুকরণের যুগে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনে মানুষ ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ এমারসন বলেছেন, “অন্যকে অনুকরণ’ই হলো আত্মহত্যা”। অনুকরণ বিহীন সত্য উপলব্ধির দ্বারা মানুষ প্রকৃত জ্ঞানের নিকটে যায় এবং এই জ্ঞানের উৎকর্ষতাই তাকে জ্ঞানের দম্ভ, অনৈতিক হওয়া থেকে রক্ষা করবে। যে যত স্বরূপ উদঘাটন করতে পারবে সে তত সত্য জানবে, সে ততই প্রকৃত জ্ঞান আবিষ্কার করতে পারবে।

লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 3546
  • Total Visits: 710918
  • Total Visitors: 2
  • Total Countries: 1125

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ বৃহস্পতিবার, ৯ই মে, ২০২৪ ইং
  • ২৬শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
  • ১লা জ্বিলকদ, ১৪৪৫ হিজরী
  • এখন সময়, বিকাল ৫:১৭

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018